শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৪:০২ অপরাহ্ন
আফতাব চৌধুরী:
আজকের পৃথিবীতে পানি ও স্থলের যে ভৌগোলিক বিন্যাস পৃথিবীর শুরুতে তা ছিল না। সাড়ে চারশো কোটি বছরের পৃথিবীতে সমুদ্র এসেছে সাড়ে তিনশো কোটি বছর আগে। এই সাড়ে চারশো কোটি বছরের ইতিহাস সমৃদ্ধ পৃথিবীর সময়কে অনেকগুলো মহাযুগও এ যুগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন ক্যামব্রিয়ান, অর্ডোভিসিয়ান, সিলুবিয়ান, ডেভোনিয়ান, কার্বোনিফেরাস, পার্মিয়ান, ট্রয়াসিক, জুরাসিক, ক্রেটেশাস ইত্যাদি। এক একটি যুগ বা মহাযুগের আবির্ভাব এবং অবসানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পৃথিবীজুড়ে সামগ্রিক আবহাওয়া ও পরিবেশের পরিবর্তন। আর প্রতিটি পরিবর্তনের ফলে শেষ হয়েছে বহু প্রাণী, যার মধ্যে রয়েছে জন্তু এবং গাছ- দুটোই। কিন্তু নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি প্রাণ পৃথিবীর বুক থেকে। নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানানসই নতুন প্রাণী সৃষ্টি হয়েছে। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন যে, মেসোজয়িক মহাযুগের শেষে উল্কাপিণ্ডের আঘাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে তখনকার প্রায় ৭৭ শতাংশ প্রাণী, যার মধ্যে ছিল বিশালাকার ডাইনোসর।
পৃথিবীর এই বিবর্তন আর সমুদ্রের উত্থান-পতনের ইতিহাস অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কোটি কোটি বছর ধরে সমদ্রের উত্থান-পতনের আভাস ভূ-বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন পাথরের স্তরে অনুসন্ধান চালিয়ে। সমুদ্রের মহা-উত্থান হয় মেসোজয়িক যুগের শেষে, অর্থাৎ প্রায় ছয় কোটি বছর আগে। এ সময় সমুদ্রে পানিতল বর্তমানের থেকে প্রায় ৩৫০ মিটার বৃদ্ধি পায়। জমা পড়ে মোটা পলির স্তর। ভারত ভূখণ্ডের উত্তরে অবস্থিত টেথিস সমুদ্র যেসব এলাকা প্লাবিত করে, যেখানে সেখানে অবক্ষিপ্ত পলির সঙ্গে মিশে থাকে অসংখ্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ফোরামিনিফেরা প্রাণী। আজ সেসব জায়গাতেই পাওয়া গেছে জ্বালানি তেল। প্লাবনে উৎপাদিত হয়েছিল বহু গাছ। মাটি ও বালির নিচে লক্ষ লক্ষ বছর চাপা পড়ে থেকে সেই গাছ ভৌত-রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে জ্বালানি কয়লায়।
অ্যান্টার্কটিকায় প্রথম বরফ জমা শুরু হয় এক কোটি চল্লিশ লক্ষ বছর আগে। উত্তর মেরুতে প্রথম বরফের স্তর জমা শুরু হয় তিরিশ লক্ষ বছর আগে। এই সময় থেকেই পৃথিবীতে বরফ যুুগের সূচনা। পৃথিবীতে শেষ মহাযুগের অর্থাৎ কোয়াটার্নারির শুরু আঠারো লক্ষ বছর আগে। পৃথিবীতে যখন দুই মেরু প্রদেশে বরফ জমে, বরফের আয়তন বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রে পানিতল নামতে থাকে। আবার এই বরফ জমা সম্পূর্ণ হলে পৃথিবীতে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বাড়ে, তখন বরফ গলে গিয়ে সমুদ্রতলের উত্থান ঘটায়। এক লক্ষ কুড়ি হাজার বছর আগে বরফ গলে সমুদ্রে পানি বাড়ে এবং প্লাবিত হয় বহু অঞ্চল। আর এক লক্ষ বছর আগেই বিবর্তনের ফলে মানুষের মস্তিষ্কের পরিমাপ বেড়ে আধুনিক মানুষের আবির্ভাব ঘটে। প্রসঙ্গত মানুষের মতো একটি উন্নত প্রাণীকে লালন করার জন্য বসুন্ধরাকে বহুদিন ধরে প্রস্তুতি নিতে হয়েছিল। এই প্রস্তুতি পর্বে দুটি বিবর্তন কাজ করেছিল। একটি হচ্ছে ভূ-পৃষ্ঠের ভূ-প্রাকৃতিক বিবর্তন, যার ফলে আজকের এই ভৌগোলিক পরিবেশ গঠিত হয়েছে। আর একটি হল প্রাণের বিবর্তন। এককোষী থেকে আজকের উন্নত মস্তিষ্কসম্পন্ন মানুষে বিবর্তন ঘটাতে প্রকৃতিকে যে কত জেনেটিক এক্সপেরিমেন্ট করতে হয়েছে তার শেষ নেই। দুটি বির্বতনেই ঘটেছে একটি প্রধান বস্তুর বা প্রাকৃতিক সম্পদের উপস্থিতি ও সহায়তায়। তার নাম পানি।
শেষ বরফ যুগ শুরু হয় মাত্র চল্লিশ হাজার বছর আগে এবং তা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছায় মাত্র এগারো হাজার বছর আগে। এই সময় সমুদ্রের পতন হয় প্রায় ২০০ মিটার। এরপর পৃথিবীর আবহাওয়া উষ্ণ হয় এবং বরফ গলতে শুরু করে। এগারো হাজার বছর আগে দুই মেরুতে যে পরিমাণ বরফ ছিল, এখন আছে তার অর্ধেক। গত এগারো বছরে সমুদ্রের উত্থান হয়েছে ১২০ মিটার। এই উত্থান পৃথিবী জুড়েই হয়েছে। এই সময়ের ব্যবধানেও সমুদ্রের বুকে ঘটেছে ছোটোখাটো উত্থান-পতনের খেলা। কোনওটা বিশ্বব্যাপী, কোনওটা আঞ্চলিক। সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে ভারতসহ বহু দেশের সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে মানব সভ্যতার নিদর্শন। তারপর পানি নেমে গেলে জেগে উঠেছে নতুন স্থলভাগ। গড়ে উঠেছে নতুন সভ্যতা। আধুনিক সভ্যতা । অতীত সমুদ্রের সৈকত রেখা ছিল কলকাতা ও খুলনার অনেকটা উত্তরে।
পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের একটা বিরাট অংশ গঙ্গা-পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র থেকে অবক্ষেপিত পলি দিয়ে গঠিত। এই এলাকাকে একত্রে বেঙ্গল বেসিন বলে। প্রায় দশ হাজার বছর আগে বঙ্গোপসাগরের পশ্চাদপসাগরেরর ফলে হিমালয় এবং রাজমহল থেকে বয়ে আনা বিপুল পলি এই বদ্বীপ অঞ্চলকে রচনা করে। মধ্য হলোসিন যুগে সমুদ্রপৃষ্ঠের উথান এই এলাকাকে পুনরায় পানিমগ্ন করে দেয়। পুরনো জারিত পলির উপর নিম্ন বদ্বীপ জাত কর্দমের স্তর জমে তাকে ঢেকে দেয়। এই সময় হিমালয়ের দ্রুত উত্থান ও ক্ষয়ক্ষতিজনিত বিপুল পরিমাণ পলি এই দক্ষিণবঙ্গে চলে আসে বিভিন্ন নদী বাহিত হয়ে। কিন্তু এই এলাকার নিচু জমিগুলো পানিমগ্ন থাকার জন্য কর্দম ও বালুকার এক মিশ্রিত অবক্ষেপ গড়ে উঠতে থাকে। এই বালু-কর্দম পুরনো অরণ্য বিভিন্ন প্রবাহের খাতের মধ্যে লেন্সের মতো স্তর গঠন করে জমে উঠতে থাকে। জৈববস্তুতে সমৃদ্ধ স্তর পিট নামে পরিচিত। কলকাতার নিচে কাদার মধ্যেও এই পিটের স্তর আছে বলে বৈজ্ঞানিকদের ধারণা।
পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে এর আগেও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে। প্রকৃতি নিজেই বিভিন্ন গ্যাসের সমতা বজায় রেখেছে। ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয় যে, পঞ্চান্ন কোটি বছর ধরে পৃথিবীতে অক্সিজেনের পরিমাণ এক বিন্দু বাড়েনি বা কমেনি। কতবার বায়ুমণ্ডল ভেদ করে নানা মাপের উল্কা পৃথিবীতে এসে আছড়ে পড়েছে। কত অগ্ন্যুৎপাত, ভূমিকম্প, ঝড়-ঝঞ্চা বয়ে গেছে। কত প্রাণ শেষ হয়েছে, কত নতুন প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে। যখনই গাছপালা বৃদ্ধি বাতাসে বিভিন্ন উপাদানের সাম্য নষ্ট করার চেষ্টা করেছে, তখনই বনাঞ্চলে দাবানল লেগেছে, ছারখার হয়ে গেছে অরণ্য। গাছপালা পচে বাতাসে মিথেন গ্যাস এর পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে প্রকৃতি অন্যরূপে তাকে বিনষ্ট করে। এগারো হাজার বছর আগে যে উষ্ণ যুগের সূচনা হয়েছিল তা এখনও চলছে। তার ফলেই পৃথিবী ধীরে ধীরে এখনও গরম হয়ে যাচ্ছে। ধাপে ধাপে বাড়ছে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা। তারই জন্যে আজও মেরু প্রদেশের বরফ গলছে। হিমালয়সহ সব উঁচু পবর্তশৃঙ্গের মাথায় অবস্থিত হিমালয় পিছু হাটছে। পৃথিবীতে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গত একশো বছরে সমুদ্র বেশ কিছুটা স্থলভাগ ভাসিয়ে দিয়েছে। প্রকৃতি তার নিয়ম মেনেই কাজ করে চলেছে। মানুষ প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া চালাতে বাধা দিলে কালিদাসের মতে বসবার ডাল কেটে নিজের পতন নিজেই ডেকে আনবে। সাংবাদিক-কলামিস্ট। ০৬.০৭.২০২১